সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে তিনি পাকিস্তানের নিষ্ঠুরতা ও নির্যাতন থেকে মুক্ত করেছেন। তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন হাজার বছরের স্বপ্ন-একটি স্বাধীন দেশ। তাই তিনি জাতির জনক। প্রতিটি শিশুকে দেশের সুনাগরিক হিসেবে যথাযথভাবে গড়ে উঠতে হবে। তাদের জানতে হবে নিজের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস,মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন: আমি জন্মেছি বাংলায়,আমি বাংলার কথা বলি, যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান; তাঁই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি- চোখে নীলাকাশ,বুকে বিশ্বাস,পায়ে উর্বর পলি। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা। শিশুদের শিক্ষা,স্বাস্থ্য,খাদ্য ও খেলাধুলার বিষয়ে তিনি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। বালক মুজিব খেলায় মেতেছেন ছেলেদের সঙ্গে।বালক বয়সেই তাঁর সঙ্গীরা তাঁকে দলপতি হিসেবে মেনে নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু খেলাধুলাও ভীষণ পছন্দ করতেন। ফুটবল,ভলিবল ও হকি খেলতেন। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলেন না,তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। বঙ্গবন্ধুর আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আব্বার টিম ও বঙ্গবন্ধুর টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুবই উপভোগ করত। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্কুল ফুটবল টিম খুব ভালো ছিল। আর মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল,তাদের এনে ভর্তি করাতেন ও বেতন ফ্রি করে দিতেন বঙ্গবন্ধু। ‘‘অসমাপ্ত আত্বজীবনী’’ হতে জানা যায়: ১৯৪০ সালে ৯ম শ্রেণির ছাত্রকালীন আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করত। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবাই নামকরা খেলোয়াড়। বছরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচদিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র।
এগারোজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত।আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন,কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না,অনেক খরচ। আমি বললাম,‘‘আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না,আমাদের পরীক্ষা।’’ গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটা করে বললেন,“তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।” আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেট পড়াতেন।আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন,‘‘ মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।” আমি বললাম “স্যার, আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারোজনই সারাবছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা,দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব। এবছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই। আর ‘‘এ জেড খান শিল্ডের” এই শেষ ফাইনাল খেলা। বঙ্গবন্ধু গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান একজন কৃতি ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি গোপালগঞ্জ ওয়ান্ডারার্স ফুটবল টিমে খেলতেন। তিনি গোপালগঞ্জসহ পাশ্ববর্তী অঞ্চলেও খেলতে যেতেন।
স্বাধীন দেশে নতুন প্রজন্মের কাছে একজন জাত খেলোয়াড়ের নামে ২০১১ সাল হতে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং তাঁর সহধর্মিণীর নামে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন খেলোয়াড়ের নামে সেই দেশের ফুটবল ক্লাব,ফুটবল স্টেডিয়াম,ফুটবল গ্যালারি ইত্যাদি নামকরণ হয়েছে। যেমন: পেলে- ব্রাজিল,ম্যারোডোনা- আর্জেন্টিনা,অলিভার কান-জার্মানি,জিনেদান জিদান-ফ্রান্স প্রমুখ। এভাবেই বাঙালি’র জনক শেখ মুজিব প্রতীকটি যুক্ত হয়ে রইল মহাকালের ইতিহাসে। কী মহৎ গর্ব আমাদের। আমার চাকরির জন্মকাল হতেই এ টুর্নামেন্ট আরম্ভ হয়। তাই অভিজ্ঞতার ভান্ডারও অত্যন্ত সমৃদ্ধ।
বিদ্যালয়-ইউনিয়ন-উপজেলা-জেলা-বিভাগ তারপর জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে শেষ হয়। মাঠ প্রশাসনের একজন সহকারি উপজেলা শিক্ষা অফিসার এর ভূমিকা খুবই অগ্রগণ্য। প্রতিটি ধাপে এ কর্মকর্তার নিরলস পরিশ্রম,সাধনা ও স্বপ্নে গড়ে ওঠে এক একটি ক্ষুদে ফুটবল টিম। দল গঠন, চিন্তা ভাবনা, কর্মপরিকল্পনা, দিকনির্দেশনা, কর্মস্পৃহা অনুপ্রেরণায় একজন শিশু শিক্ষার্থী হয়ে উঠে আদর্শ খেলোয়াড়। প্রথম কর্মস্থল পোরশা,নওগাঁয় দেখেছি এবং চেষ্টা করেছি প্রতিটি বিদ্যালয় ইউনিয়ন পর্যায়ে সকল শিশুর স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। একজন শিশু শিক্ষার্থীর একদম কাছ থেকে দেখেছি-জেনেছি তার এ টুর্নামেন্ট খেলার প্রতি প্রবল আগ্রহ। উপজেলা পর্যায়ে আয়োজন করতে গিয়ে দেখেছি এ খেলোয়াড় একটু অনুপ্রেরণা,একটু সাহস ও এক টুকরো ভালোবাসা পেলে কি যে উদ্যমী হয়ে উঠে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।যখন জেলায়-বিভাগে দল নিয়ে বাসে বসে একান্তে এ খেলা নিয়ে কথা বলেছি তখনই তাদের যে উল্লাস আনন্দ প্রকাশ পেয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। একবার কলাপাড়া-পটুয়াখালী হতে দল নিয়ে জেলায় যাচ্ছিলাম।
আমার প্রশ্ন ছিল: তোমাদের এ খেলা কেমন লাগে? তোমরা যদি আন্তরিকভাবে খেল আর মনোবল দৃঢ় থাকে তাহলে তোমরা জাতীয় পর্যায়ে খেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে গোল্ড মেডেল পুরস্কার পেতে পার? তখনই সবার বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্যার আপনি সঙ্গে থাকলে আমাদের আত্ববিশ্বাস বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট ঘরে নিয়ে আসব। এই যে, মনোবল আর মনের সাহস সত্যিই তারা নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে।ফেরার পথে তাদের যে আনন্দ আর হাসিখুশি ও বিজয়ের উল্লাস দেখেছি তা তাদের ছাত্রজীবনের শ্রেষ্ঠ উল্লাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। এ আনন্দ এ খুশি এ উল্লাস টাকা পয়সা দিয়ে কেনা সম্ভব নয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ভোলা জেলায় দল নিয়ে গেলাম তখন মাঠে নামার পর জিজ্ঞাসা করেছি- তোমাদের জন্য ছোট্র একটা উপহার আছে আমার কাছে। কে বা কারা পেতে চাও? সবাই সমস্বরে বলেছে- আমি পেতে চাই স্যার।
আমি বললাম- খেলা শেষে নির্ধারণ হবে কে বা কারা পুরস্কার-উপহার পাবে। তখন একজন শিশু শিক্ষার্থী খেলোয়াড় প্রচন্ড আগ্রহ, মনোবল আর আত্ববিশ্বাস নিয়ে বলল:‘ আমরা খেলে জয় উপহার দেব স্যার আপনাকে।’ শিশুদের আবেগ আর অনুভূতি সত্যিই আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। শিক্ষার পাশাপাশি শিশু শাস্তিমুক্ত পরিবেশে হেসে খেলে আনন্দঘন শান্তিপূর্ণ অবস্থায় সাহস আর মনোবল নিয়ে প্রতিটি শিশুর অপার সম্ভাবনা সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে তুলবে। আজকের কৃতি শিশু খেলোয়াড় আগামীদিনের দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
Leave a Reply